আটরশির পেশ ইমাম মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবের সাথে আটরশি পিরের একটি কারামত
বহু
স্মৃতি বিজড়িত বিশ্ব জাকের মঞ্জিলেরর স্বর্ণতুল্য স্মৃতির যারা ধারক,
জামানার মহা ইমাম ছাহেবের পদ পরশনে, অমিয় বচনে অঝোরে কেঁদে কেঁদে যারা
স্রষ্টা - সান্নিধ্যের পথের সন্ধান পেয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা
আলহাজ্ব আবুল হাসেম লহ্মীপুরী সাহেব।
আপন পীরের মুহাব্বতের প্রগাঢ়তা যখন সাধারণ সীমা অতিক্রম করে তখন মুরীদ এমন এক জগতে প্রবেশ করে যেখানে প্রতি কল্পনায় কল্পনায় আপন পীরের সান্নিধ্যেই সে তার সময় অতিবাহিত করে। পীরের রাবেতা সেই মুরীদের নিত্যসাথী।
বাহুল্য নয়, বরং গভীর উপলব্ধি সঞ্জাত দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি, যখন মাওলানা লহ্মীপুরীর সাথে আমরা কথা বলি তখন মনে হয়েছে যে পীর মুরীদের এমনই এক বলয়ে তিনি নিজেকে সমর্থন করেছেন যেখানে অতীত আর বর্তমানের তফাৎ খুবই কম। স্পষ্ট করে যদি বলি তবে বলতে হয়, কেবলাজানের বেছালৎ যদিও তাকে করছে শোকাহত তথাপি আপন পীরের সার্বহ্মণিক উপস্থিতি তিনি টের পান।
অতীতে কেবলাজান ছিলেন আর বর্তমানে তিনি নেই-- এই জাতীয় জড়তায় তিনি আক্রান্ত নন। বরং এখনও তার মনে হয় কেবলাজান সকলের মাঝেই আছেন এবং সকল কর্মকান্ড পরিচালিত করছেন।
পরিচিতি প্রসঙ্গে আসি---- মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবের বর্তমান বয়স ৬০ । পিতার সাথেই তিনি প্রথমে দরবার শরীফে আসেন। দরবার শরীফের মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেছেন। স্থায়ীভাবে তিনি দরবার শরীফে আসেন ১৯৮০ সালে। শ্রদ্ধেয় আলহাজ্ব শাহাবুদ্দিন খান ( মিয়া মামা) হুজুুর কেবলাজানের নির্দেশে মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবকে চিঠি লিখে দরবার শরীফে আসতে জানান। তিনি তখন থেকেই দরবার শরীফে থাকতে শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই ওলী আল্লাহ সকলের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শুনতেন ওলী আল্লাহ সকলের সাথে মহব্বত স্থাপন করলে অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখা যায়। বস্তুুত তিনি কেবলাজানের অনেক আশ্চর্য ঘটনার প্রত্যহ্ম স্বাহ্মী।
নিজের জীবনে কেবলাজানের তাইদ ও মদদ পাওয়া এবং অনেক দয়ার প্রকাশ পাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বললেন যে, বিয়ের পর তিনি ১৫ বছর যাবৎ সন্তানহীন ছিলেন। আলাউদ্দীন সাহেব, মাওলানা সাদেকুর রহমান প্রমুখ তার ব্যাপারে একদিন হুজুর কেবলাজানের কাছে নালিশ জানালে কেবলাজান বললেন, আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করেছি, আল্লাহ পাক জানিয়েছেন পুত্রের বয়স ২ মাস। এই ঘটনার পর মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব বাড়ীতে যান এবং জানতে পারেন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তার পুত্র বর্তমানে ৫ম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত।মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব ১৯৮৮ সালে দরবার শরীফের মসজিদের পেশ ইমাম নিযুক্ত হন। কেবলাজানের হুকুমে আরও চারজন জাকের ভাই (মাওলানা আবুল্লাইছ আনছারী, মাওলানা দেওবন্দী সাহেব, মাওলানা ছাদেকুর রহমান, মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব ) সহকারে মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব ১৯৮৮ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেন।
লহ্মীপুরী সাহেব বললেন, কেবলাজান বহু পূর্ব হতেই বলতেন ইসলামের বিজয়ের কথা, ভবিষ্যতে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের স্বরুপের কথা। নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান তিনি মনে করেন কেননা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি কেবলাজানের সাথে পড়তেন এবং কেবলাজানের নির্দেশে তিনি ইমামতি করতেন। এ যেন স্মৃতির অমূল্য স্বর্ণমালা। এখনও কেবলাজানের জড়দেহের অনুপস্থিতিতে তিনি বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে ইমামতি করেন কিন্তুু কখনোই তার মনের কোণে একথা স্থান পায় না যে, কেবলাজান নেই। বরং পূর্বেও যেমন তিনি মনে করতেন বর্তমানেও ঠিক তেমনি মনে করেন যে কেবলাজান জামাতে শামিল আছেন। এই উপলব্ধি তার মধ্যে জাগ্রত।
অনেক স্মৃতির আধার মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবের জীবনে কেবলাজান ছাহেবের অনেক অলৌকিকতা প্রতিভাত এবং প্রকাশিত হয়েছে। হজ্ব পালনকালে হাজরে আসওয়াদ চুম্বনকালে প্রচন্ড চাপাচাপি সত্ত্বেও তিনি অনায়াসে কালো পাথর চুম্বনে সমর্থ হন যা কেবলাজানের তাইদ ও মদদে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি তার সতীর্থদের হারিয়ে ফেলেন এবং দেখতে পান যে হজরত কেবলাজান আগে আগে চলে তাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন এবং এভাবেই তিনি মক্কা নগরীতে তার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। যেই মুহুর্তে তিনি আত্মীয়ের দেখা পান সেই মুহুর্তেই কেবলাজান হঠাৎ করেই মিলিয়ে যান। কেবলাজান ছাহেবের বড় জামাতা জনাব আদেল উদ্দিন হাওলাদার সাহেবের ইনতিকালের পর মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব তার কাফন পরান এবং অন্যান্য আনুষ্টানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন। এর দুই দিন পর এশার নামাজান্তে তিনি তার বাসায় জায়নামাজে বসে ছিলেন। হঠাৎ খোলা চোখেই তিনি দেখলেন যে বড় দুলা ভাইজানেরর খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে খাটিয়ায় দুলাভাইজান কাফনাবৃত। কিন্তুু পেছনে পেছনে দুলাভাইজান তার খাটিয়ার সাথে হেঁটে চলছেন। দুইজন একই রকম মানুষ দেখে বিস্মিত লহ্মীপুরী সাহেব জায়নামাজে বসেই দুলাভাইজানকে এই আশ্চর্যজনক ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করলে দুলাভাইজান উত্তর দেন " মুসলমানের মৃত্যু নাই। "
পরদিন কেবলাজানেরর সন্মুখে হাজির হয়ে দুইজন দুলাভাইজানের এক সাথে দেখা যাওয়ার কথা খানিকটা বলতেই হযরত কেবলাজান বলে উঠেন,--- মুসলমানের মৃত্যু নাই।"
কয়জন মুরীদের ভাগ্য হয় আপন পীরের পবিত্র দেহ মুবারকে স্বর্ণকায় কাফন পরিয়ে দেয়ার। কয়জন এমন নসীবের অধিকারী হন যারা জামানার শেষ্ঠতম তাপস, জামানার মুজাদ্দেদ ছাহেবের শেষ গোসল করানোর দায়িত্ব পান।বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের অগনিত জাকেরান আশেকানগন বহুভাবে কেবলাজানের তাইদ মদদ দয়া পেয়েছেন। পেয়েছেন সেই সাথে লহ্মীপুরী সাহেবও কিন্তুু তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা কেবলাজান ছাহেবের শেষ গোসলে তার উপস্থিতি। কেবলাজান ছাহেবের রুহানী উত্তরাধিকারী পীরজাদা মিয়াভাইজান মুজাদ্দেদী এবং মেঝোভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেবদ্বয়ের নির্দেশে লহ্মীপুরী সাহেব কয়েকজন বিশিষ্ট খাদেম ( আজমীর ভাই, বকর ভাই, মাওলানা রুহুল আমীন রংপুরী, মাওলানা জয়নাল আবেদীন ) সাথে নিয়ে দয়াল পীর দস্তগীর কোটি জাকেরের নূরের পুতুল খাজা ফরিদপুরী ( কুঃছিঃআঃ) ছাহেবের পবিত্র গোসল মুবারক সম্পন্ন করেন। যখন লহ্মীপুরী সাহেব আমাদের কাছে সেই ঘটনার কথা বলতে শুরু করেন তার দুই চোখ বেয়ে নামছিল অশ্রু ধারা। বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে শব্দ না করেই তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, জাগতিকভাবে অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে অনেকদিন কেবলাজানকে না দেখে মনটা খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল। তাই বনানী দরবার শরীফে ছুটে গিয়েছিলাম কেবলাজানকে এক নজর দেখার আশায়। কিন্তুু ভাগ্যে না থাকায় অত্যন্ত ব্যথিত মনে আমাকে ফিরে আসতে হয় কেবলাজানকে না দেখেই। কিন্তুু তখন বুঝিনি আমার পীর কেবলাজানকে এমনভাবে এত কাছ থেকে শেষ দেখা আমি দেখব। পবিত্র গোসল মুবারক সম্পন্ন করার জন্য আমি যখন কেবলাজানের দিকে তাকালাম তখন মনে হলো যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ এক অপরুপ শিশু। মনে হচ্ছিল বুকে তুলে জড়িয়ে ধরি। সর্ব প্রথম হযরত মিয়া ভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেব এবং হযরত মেজভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেব কেবলাজান হুজুরের পবিত্র কদম মুবারক ধুইয়ে দেন। তারপর আমি গোসলের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করি।
আমার সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল ওলী আল্লাহ সকল অমর। মনে পড়ল হযরত গাউস পাকের (রঃ) কথা যার এনতেকালের পরেও জাগ্রত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আমি দুই হাত দিয়ে চহ্মু মুবারকদ্বয় বন্ধ করে দিলাম। কিছুহ্মন পর যখন কেবলাজানের পিঠ মুবারকে পানি ঢালি তখন আবার কেবলাজান হঠাৎ করে চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন। আমি আবারও চহ্মুমুবারকদ্বয় বন্ধ করলাম। গোসল শেষ হলে কেবলাজানকে কাফন পরানোর সময়ে মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব আমাদের সাথে শামিল হন। কেবলাজান ছাহেবের ছাহেবজাদাদের ইচ্ছা ছিল জাকেররা যাতে এক নজর শেষ বারের মত দেখতে পারে। কিন্তুু পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল যে রওজাশরীফের জন্য নির্ধারিত জায়গায় খাটিয়া মুবারক নিয়ে যেতে খুবই কষ্ট হয়েছে। কেবলাজানের শরীয়তের অনুপস্থিতি প্রসংগে তার উপলব্ধির কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, কেবলাজান এখনও আছেন। সেদিনও দেখলাম তিনি ঘুরে ঘুরে উরস শরীফের সমুদয় কর্মকান্ড ও প্রস্তুতিকার্য পরিদর্শন করছেন ( সম্ভবতঃ তিনি স্বপ্নের কথা বলেছেন) ।
অনেক আগের মানুষ লহ্মীপুরী সাহেব অনেক প্রবীন জাকেরদের মতই ভাগ্যবান। কেবলাজান ছাহেবের সান্নিধ্য যারা যত বেশী পেয়েছেন তারা ততই বেশী মূল্যবান। অন্তত আমাদের কাছে। আমরা যারা নবীন, যারা খুব বেশীদিন কেবলাজানের জাগতিক সান্নিধ্যের পরশ পাইনি তাদের কাছে প্রবীণ জাকের সকল রত্নতুল্য। কেননা তাদের কাছে বসলে কেবলাজানের কত কথা যে শোনা যায় তার ইয়ত্তা নেই। লহ্মীপুরী সাহেব আলোচনাকালে বললেন যে, কেবলেজান বহু পূর্ব হতেই ইসলামের বিজয়ের কথা বলতেন। বলতেন জাকের মঞ্জিলে হতে ইসলামের বিজয় সূচিত হবে। তিনি যে নসিহত প্রকাশ করবেন সে কথাও কেবলাজান বহু পূর্ব হতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের মাথার তাজ মিয়া ভাইজান এবং মেঝভাইজান মুুজাদ্দেদী ছাহেবদ্বয় সম্পর্কে কেবলাজান কি বলতেন সে কথা " লহ্মীপুরী সাহেব বললেন, কেবলাজান বলতেন -- আমাকে যতটুকু ভয় করেন, তার চেয়ে বেশী ভয় আপনার দুই ভাইজানকে করবেন। কেননা, তাদের নরম মন, যদি তারা কোন কথা বলে বসেন তাহলে পরবর্তীতে তাঁরা নিজেরাও তা আর ফেরাতে পারবে না। তাই এখন ভাইজানদের দেখলে আমার খুব ভয় হয়। আমি ঘামিয়ে যাই, অস্থির হয়ে যাই, কেননা কেবলাজানের সেই কথা আমার মনে পড়ে।
আমরা যখন লহ্মীপুরী সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম তখন আমার মনে হচ্ছিল এমন অনেক কথাই তিনি বলে ফেললেন যা জড়বাদী সমাজের কাছে অসম্ভব, অযৌক্তিক মনে হবে। কিন্তুু আমার মনে হয় তিনি এজন্য এতকিছু বললেন যে, একদিন তিনিও দুনিয়া হতে বিদায় নেবেন। তিনি হয়তবা ভেবেছেন যে, জামানার মুরাদ ফকীরের পবিত্র জীবনের যতটুকু তিনি উপলব্ধি করেছেন তার কিয়দংশ হলেও প্রকাশ করা উচিত। কেননা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে এই দরবারে আসবে। তাদের জানার হক রয়েছে। আর অতীতেও ওলী আল্লাহ সকলের কথা তদীয় সিলসিলার অনুসারীবর্গ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। যেমন সৃষ্টিকূলের সর্দার রাসূলে পাক (সাঃ)- এর পবিত্র জীবনাদর্শ, অলৌকিকতা তাঁর সাহাবাগণের মাধ্যমেই যুগে যুগে প্রচারিত হয়েছে এবং আজও সেই তথ্য আমরা পাচ্ছি।
পরিশেষে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল কথাটার অর্থ নতুনভাবে লহ্মীপুরী সাহেবের কাছে শুনলাম। তিনি বললেন যে, বিশ্ব+জাকের+মঞ্জিল এই কথার মধ্যেই কেবলাজানের হেদায়েতের পরিসীমা এবং ব্যাপকতা লুকায়িত।বিশ্ব অর্থ পৃথিবী, জাকের অর্থ যারা জেকের করেন এবং মঞ্জিল অর্থ ঘাঁটি। সমস্ত বিশ্বেই কেবলাজানের পদচারণা এবং সমগ্র বিশ্বই তাঁর ঘাঁটি। তিনি তার জাগতিক সীমানার মধ্যে থেকেও যে সমুদয় কুল মাখলুকাতের খবর রাখেন তা ভুক্তভোগী সালেকমাত্রই টের পান।
মাওলানা লহ্মীপুরী
----পেশ ইমাম----
আপন পীরের মুহাব্বতের প্রগাঢ়তা যখন সাধারণ সীমা অতিক্রম করে তখন মুরীদ এমন এক জগতে প্রবেশ করে যেখানে প্রতি কল্পনায় কল্পনায় আপন পীরের সান্নিধ্যেই সে তার সময় অতিবাহিত করে। পীরের রাবেতা সেই মুরীদের নিত্যসাথী।
বাহুল্য নয়, বরং গভীর উপলব্ধি সঞ্জাত দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি, যখন মাওলানা লহ্মীপুরীর সাথে আমরা কথা বলি তখন মনে হয়েছে যে পীর মুরীদের এমনই এক বলয়ে তিনি নিজেকে সমর্থন করেছেন যেখানে অতীত আর বর্তমানের তফাৎ খুবই কম। স্পষ্ট করে যদি বলি তবে বলতে হয়, কেবলাজানের বেছালৎ যদিও তাকে করছে শোকাহত তথাপি আপন পীরের সার্বহ্মণিক উপস্থিতি তিনি টের পান।
অতীতে কেবলাজান ছিলেন আর বর্তমানে তিনি নেই-- এই জাতীয় জড়তায় তিনি আক্রান্ত নন। বরং এখনও তার মনে হয় কেবলাজান সকলের মাঝেই আছেন এবং সকল কর্মকান্ড পরিচালিত করছেন।
পরিচিতি প্রসঙ্গে আসি---- মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবের বর্তমান বয়স ৬০ । পিতার সাথেই তিনি প্রথমে দরবার শরীফে আসেন। দরবার শরীফের মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেছেন। স্থায়ীভাবে তিনি দরবার শরীফে আসেন ১৯৮০ সালে। শ্রদ্ধেয় আলহাজ্ব শাহাবুদ্দিন খান ( মিয়া মামা) হুজুুর কেবলাজানের নির্দেশে মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবকে চিঠি লিখে দরবার শরীফে আসতে জানান। তিনি তখন থেকেই দরবার শরীফে থাকতে শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই ওলী আল্লাহ সকলের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শুনতেন ওলী আল্লাহ সকলের সাথে মহব্বত স্থাপন করলে অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখা যায়। বস্তুুত তিনি কেবলাজানের অনেক আশ্চর্য ঘটনার প্রত্যহ্ম স্বাহ্মী।
নিজের জীবনে কেবলাজানের তাইদ ও মদদ পাওয়া এবং অনেক দয়ার প্রকাশ পাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বললেন যে, বিয়ের পর তিনি ১৫ বছর যাবৎ সন্তানহীন ছিলেন। আলাউদ্দীন সাহেব, মাওলানা সাদেকুর রহমান প্রমুখ তার ব্যাপারে একদিন হুজুর কেবলাজানের কাছে নালিশ জানালে কেবলাজান বললেন, আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করেছি, আল্লাহ পাক জানিয়েছেন পুত্রের বয়স ২ মাস। এই ঘটনার পর মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব বাড়ীতে যান এবং জানতে পারেন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তার পুত্র বর্তমানে ৫ম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত।মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব ১৯৮৮ সালে দরবার শরীফের মসজিদের পেশ ইমাম নিযুক্ত হন। কেবলাজানের হুকুমে আরও চারজন জাকের ভাই (মাওলানা আবুল্লাইছ আনছারী, মাওলানা দেওবন্দী সাহেব, মাওলানা ছাদেকুর রহমান, মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব ) সহকারে মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব ১৯৮৮ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেন।
লহ্মীপুরী সাহেব বললেন, কেবলাজান বহু পূর্ব হতেই বলতেন ইসলামের বিজয়ের কথা, ভবিষ্যতে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের স্বরুপের কথা। নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান তিনি মনে করেন কেননা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি কেবলাজানের সাথে পড়তেন এবং কেবলাজানের নির্দেশে তিনি ইমামতি করতেন। এ যেন স্মৃতির অমূল্য স্বর্ণমালা। এখনও কেবলাজানের জড়দেহের অনুপস্থিতিতে তিনি বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে ইমামতি করেন কিন্তুু কখনোই তার মনের কোণে একথা স্থান পায় না যে, কেবলাজান নেই। বরং পূর্বেও যেমন তিনি মনে করতেন বর্তমানেও ঠিক তেমনি মনে করেন যে কেবলাজান জামাতে শামিল আছেন। এই উপলব্ধি তার মধ্যে জাগ্রত।
অনেক স্মৃতির আধার মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেবের জীবনে কেবলাজান ছাহেবের অনেক অলৌকিকতা প্রতিভাত এবং প্রকাশিত হয়েছে। হজ্ব পালনকালে হাজরে আসওয়াদ চুম্বনকালে প্রচন্ড চাপাচাপি সত্ত্বেও তিনি অনায়াসে কালো পাথর চুম্বনে সমর্থ হন যা কেবলাজানের তাইদ ও মদদে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি তার সতীর্থদের হারিয়ে ফেলেন এবং দেখতে পান যে হজরত কেবলাজান আগে আগে চলে তাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন এবং এভাবেই তিনি মক্কা নগরীতে তার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। যেই মুহুর্তে তিনি আত্মীয়ের দেখা পান সেই মুহুর্তেই কেবলাজান হঠাৎ করেই মিলিয়ে যান। কেবলাজান ছাহেবের বড় জামাতা জনাব আদেল উদ্দিন হাওলাদার সাহেবের ইনতিকালের পর মাওলানা লহ্মীপুরী সাহেব তার কাফন পরান এবং অন্যান্য আনুষ্টানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন। এর দুই দিন পর এশার নামাজান্তে তিনি তার বাসায় জায়নামাজে বসে ছিলেন। হঠাৎ খোলা চোখেই তিনি দেখলেন যে বড় দুলা ভাইজানেরর খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে খাটিয়ায় দুলাভাইজান কাফনাবৃত। কিন্তুু পেছনে পেছনে দুলাভাইজান তার খাটিয়ার সাথে হেঁটে চলছেন। দুইজন একই রকম মানুষ দেখে বিস্মিত লহ্মীপুরী সাহেব জায়নামাজে বসেই দুলাভাইজানকে এই আশ্চর্যজনক ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করলে দুলাভাইজান উত্তর দেন " মুসলমানের মৃত্যু নাই। "
পরদিন কেবলাজানেরর সন্মুখে হাজির হয়ে দুইজন দুলাভাইজানের এক সাথে দেখা যাওয়ার কথা খানিকটা বলতেই হযরত কেবলাজান বলে উঠেন,--- মুসলমানের মৃত্যু নাই।"
কয়জন মুরীদের ভাগ্য হয় আপন পীরের পবিত্র দেহ মুবারকে স্বর্ণকায় কাফন পরিয়ে দেয়ার। কয়জন এমন নসীবের অধিকারী হন যারা জামানার শেষ্ঠতম তাপস, জামানার মুজাদ্দেদ ছাহেবের শেষ গোসল করানোর দায়িত্ব পান।বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের অগনিত জাকেরান আশেকানগন বহুভাবে কেবলাজানের তাইদ মদদ দয়া পেয়েছেন। পেয়েছেন সেই সাথে লহ্মীপুরী সাহেবও কিন্তুু তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা কেবলাজান ছাহেবের শেষ গোসলে তার উপস্থিতি। কেবলাজান ছাহেবের রুহানী উত্তরাধিকারী পীরজাদা মিয়াভাইজান মুজাদ্দেদী এবং মেঝোভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেবদ্বয়ের নির্দেশে লহ্মীপুরী সাহেব কয়েকজন বিশিষ্ট খাদেম ( আজমীর ভাই, বকর ভাই, মাওলানা রুহুল আমীন রংপুরী, মাওলানা জয়নাল আবেদীন ) সাথে নিয়ে দয়াল পীর দস্তগীর কোটি জাকেরের নূরের পুতুল খাজা ফরিদপুরী ( কুঃছিঃআঃ) ছাহেবের পবিত্র গোসল মুবারক সম্পন্ন করেন। যখন লহ্মীপুরী সাহেব আমাদের কাছে সেই ঘটনার কথা বলতে শুরু করেন তার দুই চোখ বেয়ে নামছিল অশ্রু ধারা। বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে শব্দ না করেই তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, জাগতিকভাবে অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে অনেকদিন কেবলাজানকে না দেখে মনটা খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল। তাই বনানী দরবার শরীফে ছুটে গিয়েছিলাম কেবলাজানকে এক নজর দেখার আশায়। কিন্তুু ভাগ্যে না থাকায় অত্যন্ত ব্যথিত মনে আমাকে ফিরে আসতে হয় কেবলাজানকে না দেখেই। কিন্তুু তখন বুঝিনি আমার পীর কেবলাজানকে এমনভাবে এত কাছ থেকে শেষ দেখা আমি দেখব। পবিত্র গোসল মুবারক সম্পন্ন করার জন্য আমি যখন কেবলাজানের দিকে তাকালাম তখন মনে হলো যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ এক অপরুপ শিশু। মনে হচ্ছিল বুকে তুলে জড়িয়ে ধরি। সর্ব প্রথম হযরত মিয়া ভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেব এবং হযরত মেজভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেব কেবলাজান হুজুরের পবিত্র কদম মুবারক ধুইয়ে দেন। তারপর আমি গোসলের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করি।
আমার সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল ওলী আল্লাহ সকল অমর। মনে পড়ল হযরত গাউস পাকের (রঃ) কথা যার এনতেকালের পরেও জাগ্রত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আমি দুই হাত দিয়ে চহ্মু মুবারকদ্বয় বন্ধ করে দিলাম। কিছুহ্মন পর যখন কেবলাজানের পিঠ মুবারকে পানি ঢালি তখন আবার কেবলাজান হঠাৎ করে চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন। আমি আবারও চহ্মুমুবারকদ্বয় বন্ধ করলাম। গোসল শেষ হলে কেবলাজানকে কাফন পরানোর সময়ে মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব আমাদের সাথে শামিল হন। কেবলাজান ছাহেবের ছাহেবজাদাদের ইচ্ছা ছিল জাকেররা যাতে এক নজর শেষ বারের মত দেখতে পারে। কিন্তুু পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল যে রওজাশরীফের জন্য নির্ধারিত জায়গায় খাটিয়া মুবারক নিয়ে যেতে খুবই কষ্ট হয়েছে। কেবলাজানের শরীয়তের অনুপস্থিতি প্রসংগে তার উপলব্ধির কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, কেবলাজান এখনও আছেন। সেদিনও দেখলাম তিনি ঘুরে ঘুরে উরস শরীফের সমুদয় কর্মকান্ড ও প্রস্তুতিকার্য পরিদর্শন করছেন ( সম্ভবতঃ তিনি স্বপ্নের কথা বলেছেন) ।
অনেক আগের মানুষ লহ্মীপুরী সাহেব অনেক প্রবীন জাকেরদের মতই ভাগ্যবান। কেবলাজান ছাহেবের সান্নিধ্য যারা যত বেশী পেয়েছেন তারা ততই বেশী মূল্যবান। অন্তত আমাদের কাছে। আমরা যারা নবীন, যারা খুব বেশীদিন কেবলাজানের জাগতিক সান্নিধ্যের পরশ পাইনি তাদের কাছে প্রবীণ জাকের সকল রত্নতুল্য। কেননা তাদের কাছে বসলে কেবলাজানের কত কথা যে শোনা যায় তার ইয়ত্তা নেই। লহ্মীপুরী সাহেব আলোচনাকালে বললেন যে, কেবলেজান বহু পূর্ব হতেই ইসলামের বিজয়ের কথা বলতেন। বলতেন জাকের মঞ্জিলে হতে ইসলামের বিজয় সূচিত হবে। তিনি যে নসিহত প্রকাশ করবেন সে কথাও কেবলাজান বহু পূর্ব হতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের মাথার তাজ মিয়া ভাইজান এবং মেঝভাইজান মুুজাদ্দেদী ছাহেবদ্বয় সম্পর্কে কেবলাজান কি বলতেন সে কথা " লহ্মীপুরী সাহেব বললেন, কেবলাজান বলতেন -- আমাকে যতটুকু ভয় করেন, তার চেয়ে বেশী ভয় আপনার দুই ভাইজানকে করবেন। কেননা, তাদের নরম মন, যদি তারা কোন কথা বলে বসেন তাহলে পরবর্তীতে তাঁরা নিজেরাও তা আর ফেরাতে পারবে না। তাই এখন ভাইজানদের দেখলে আমার খুব ভয় হয়। আমি ঘামিয়ে যাই, অস্থির হয়ে যাই, কেননা কেবলাজানের সেই কথা আমার মনে পড়ে।
আমরা যখন লহ্মীপুরী সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম তখন আমার মনে হচ্ছিল এমন অনেক কথাই তিনি বলে ফেললেন যা জড়বাদী সমাজের কাছে অসম্ভব, অযৌক্তিক মনে হবে। কিন্তুু আমার মনে হয় তিনি এজন্য এতকিছু বললেন যে, একদিন তিনিও দুনিয়া হতে বিদায় নেবেন। তিনি হয়তবা ভেবেছেন যে, জামানার মুরাদ ফকীরের পবিত্র জীবনের যতটুকু তিনি উপলব্ধি করেছেন তার কিয়দংশ হলেও প্রকাশ করা উচিত। কেননা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে এই দরবারে আসবে। তাদের জানার হক রয়েছে। আর অতীতেও ওলী আল্লাহ সকলের কথা তদীয় সিলসিলার অনুসারীবর্গ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। যেমন সৃষ্টিকূলের সর্দার রাসূলে পাক (সাঃ)- এর পবিত্র জীবনাদর্শ, অলৌকিকতা তাঁর সাহাবাগণের মাধ্যমেই যুগে যুগে প্রচারিত হয়েছে এবং আজও সেই তথ্য আমরা পাচ্ছি।
পরিশেষে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল কথাটার অর্থ নতুনভাবে লহ্মীপুরী সাহেবের কাছে শুনলাম। তিনি বললেন যে, বিশ্ব+জাকের+মঞ্জিল এই কথার মধ্যেই কেবলাজানের হেদায়েতের পরিসীমা এবং ব্যাপকতা লুকায়িত।বিশ্ব অর্থ পৃথিবী, জাকের অর্থ যারা জেকের করেন এবং মঞ্জিল অর্থ ঘাঁটি। সমস্ত বিশ্বেই কেবলাজানের পদচারণা এবং সমগ্র বিশ্বই তাঁর ঘাঁটি। তিনি তার জাগতিক সীমানার মধ্যে থেকেও যে সমুদয় কুল মাখলুকাতের খবর রাখেন তা ভুক্তভোগী সালেকমাত্রই টের পান।
মাওলানা লহ্মীপুরী
----পেশ ইমাম----