উরস, উরসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব এবং ইহার বৈধতার দলিলঃ
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম
‘উরস’ আরবী শব্দ। লোগাত বা অভিধানে ইহার নানাবিধ অর্থ পরিলক্ষিত হয়।ওলেমা, বিবাহ বা বিবাহ উপলক্ষে খানা-পিনা, ফূলশয্যার বাসর যাপন ইত্যাদি উরস শব্দের আভিধানিক অর্থ। লোগাত সাঈদী, লোগাত ফেরোজী বা মেছবাহুল লোগাতে উল্লিখিত অর্থ দেখা যায়। ইহা ছাড়াও উরস শব্দের আরও দুইটি বিশেষ অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ
মিলন,
ওলী-আল্লাহগণের বা পীরে কামেলগণের মৃতুবার্ষিকীতে তাঁহাদের পবিত্র রূহে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে উদ্যাপিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
ডঃ শেখ গোলাম মাক্ছুদ সম্পাদিত ‘‘Perso Arabic elements in Bengali” গ্রন্থে উরস শব্দের নিম্নলিখিত দুইটি অর্থ দেখা যায়ঃ- Anniversary in memory of a saint-যাহার অর্থ দাঁড়ায়ঃ কোন খোদাতত্ত্বজ্ঞ সাধকের মৃত্যুবার্ষিকী উৎযাপন অথবা সাধকের স্মরণে আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি। ডঃ এনামুল হক সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে উরস শব্দের অর্থ লেখা আছেঃ ওলী দরবেশের বেছালতে তাঁহাদের সমাধিস্থলে পবিত্র অনুষ্ঠান বিশেষ।
উরস শব্দের মূল ভাষাগত বা ব্যুতপত্তিগত অর্থ মিলন। ওলী-আল্লাহসকল বা খোদাতত্ত্বজ্ঞ সাধকবর্গ ইন্তেকালের সাথে সাথে খোদাতায়ালার সান্নিধ্যে চলিয়া যান, খোদাতায়ালার সহিত মিলিত হন। এই মিলন হয় মাশুকের সহিত আশেকের, বিশ্ব আত্মার সহিত পুণ্যাত্মার। এই মিলন বড় আনন্দময়। আর মৃত্যুই এই মহামিলনে সহায়তা করে বিধায় রাসূলে পাক (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘‘মৃত্যু একটি সেতু যাহা বন্ধুর সাথে বন্ধুর মিলন ঘটায়।” এই আনন্দময় আধ্যাত্মিক মহামিলন নবী (আঃ) গণ ও নায়েবে নবী তথা ওলী-আল্লাহগণের ভাগ্যেই ঘটে। কারণ তাহারা বন্ধুত্বের মর্যাদা প্রাপ্ত। তাহারা নাফসে আম্মারার সাথে জেহাদ করিয়া তথা জেহাদে আকবরে নাফসকে পর্যুদস্ত করিয়া, দুনিয়ার দাসত্ব মুক্ত হইয়া, দৈহিক আকর্ষণ ছিন্ন করিয়া, দুনিয়ায় অবস্থান কালেই খোদাতায়ালার সান্নিধ্যে পৌঁছান, খোদাতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করেন এবং তদীয় বন্ধুত্বের আসনে আসীন হন। তাই ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই তাহারা খোদাতায়ালার সহিত বা বিশ্ব আত্মার সহিত মিলিত হওয়ার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যশালী হন। ইহা পরম আনন্দঘন এক আধ্যাত্মিক মিলন।
যে দিবসে সাধকের পুণ্যাত্মা বিশ্ব আত্মার সহিত মিলিত হয়, সেই দিবসে তাঁহার পবিত্র রূহে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করা হয়-তাহা ‘‘উরস” নামে খ্যাত.।উরস শব্দের আরও এক অর্থ আছে। ফেরেশতা মুনকীর নাকীর কবরবাসীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করিবেন। মুনকির-নাকিরের প্রশ্নে ঈমানদার কবরবাসী যদি যথাযথ জওয়াব দিতে সক্ষম হন, তবে ফেরেশতা দুইজন তাহার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘তুমি সেই দুলহানের মত ঘুমাইয়া থাক, যাহাকে তাহার প্রিয়জন ছাড়া আর কেহই উঠাইতে পারিবে না।”
ফেরেশতাদ্বয়ের কথায় এখানে ‘‘উরস” শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে যাহা ‘‘ফুলশয্যার বাসর” কে ইংগিত করে। তাই হয়তো উরসের আর এক অর্থ বাসর যাপন।
তবে ওলী-আল্লাহগণের দরবারের যে পবিত্র উরস শরীফ নামক ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়-তাহা মূলতঃ কোন প্রয়াত আল্লাহওয়ালার বেছালত দিবসে তাঁহারই রূহ মোবারকে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে আয়োজিত মজলিস। ইহা অত্যন্ত বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ অনুষ্ঠান।
পূর্ব জামানা হইতেই উরসের অনুষ্ঠানাদি পালিত হইয়া আসিতেছে। তবে নামের তফাত ছিল মাত্র। যেমন ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহম বা ফাতেহা-ই- ইয়াজদাহম। রাসূলে পাক (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে যে ফাতেহা উদ্যাপন করা হয়-তাহাই ফাতেহা-ই- দোয়াজদাহম। ইহা মূলতঃ উরসই, তবে নামে তফাত মাত্র।আবু জাফর রচিত ‘Muslim Fesivals in Bangladesh’- নামক পুস্তকে দেখা যায়ঃ হযরত গাউস পাক আব্দুল কাদের জেলানী (রাঃ) ছাহেব তাহার খানকায় মহাধুমধামের সাথে ১২ই রবউল আউয়ালে ফাতেহা-ই দোয়াজদাহম উদযাপন করিতেন এবং দয়াল নবী (সাঃ) এর পবিত্র আত্মায় ছওয়াব রেছানী করিতেন। ইহাতে হযরত গউস পাক (রাঃ) ছাহেবের প্রতি হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) অত্যন্ত প্রীত হন এবং এক স্বপ্নে তাহাকে বলেন যে, পরবর্তীতে মোসলমানসকল ১২-ই শরীফ আর্থাৎ ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহমের সংগে ১১ই শরীফ আর্থাৎ ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম পালন করিবে। বাস্তবে দেখাও গেল তাই। ১১ই শরীফ হযরত গাউস পাক (রাঃ) ছাহেবের বেছালত (ওফাত) দিবস। বিশ্বের বহু জায়গাতে হযরত গউস পাক (রাঃ) ছাহেবের ওফাত দিবসে তাহারই পবিত্র রূহে ছওয়াব প্রেরণের জন্য ফাতেহা অনুষ্ঠান উদ্যাপন করা হয়। ইহাও উরস বৈ কি।
উপরের আলোচনা হইতে বুঝা গেল, পবিত্র উরস শরীফ হইল ছওয়াব রেছানীর অনুষ্ঠান। জামে আউলিয়া, জামে আম্বিয়া ও তামাম মোসলমানদের বিদেহী রূহ পাকে ছওয়াব রেছানী করা হয়।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে আয়োজিত পবিত্র উরস শরীফের অনুষ্ঠান চার দিনে ব্যাপী চলিতে থাকে। শনি রবি, সোম ও মঙ্গলবার। আমার পীর কেবলা হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব এই ধুলির ধরায় আবির্ভূত হন বাংলা ১২৯৩ সনের ২১ কার্তীক, হিজরী ১৩০৩ সনের ১১ই জিলহজ্ব রোজ শনিবার সুবেহ ছাদেকের সময়ে। আবার ৬৫ বৎসর অন্তে বাংলা ১৩৫৮ সনের ১৮ই ফাল্গুন রোজ রোববার বেলা ১২-১৫ মিনিটের সময় লক্ষ লক্ষ মুরীদ সন্তানদেরকে শোক সাগরে ভাসাইয়া দারুল বাকায় তশরীফ রাখেন। তাহার পবিত্র দেহ সমাহিত করা হয় সোমবার বিকাল চারটার সময়। কাজেই শনিবার তাহার জন্মদিবস, রোববার ওফাত দিবস এবং সোমবার তদীয় সমাহিত দিবস।
চারদিন ব্যাপী উদযাপনকৃত উরস শরীফের প্রথম তিন দিন অর্থাত শনি, রবি ও সোমবার আমার পীর ছাহেব, হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের পাক আত্মায় ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। অবশিষ্ট থাকে একদিন-মঙ্গলবার। আমার দাদা পীর, হযরত শাহসূফী সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রঃ) ছাহেবের (যিনি হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের পীর কেবলা) বেছালত দিবস মঙ্গলবার। তাঁহারই রূহ পাক হুজুরে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে মঙ্গলবারকে উরস শরীফের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। । উল্লিখিত চারদিন ব্যাপী পবিত্র উরসের কর্মসূচী চলিতে থাকে।
ইহা ছাড়াও ছওয়াব রেছানী করা হয় সকল নবী-রাসূল (আঃ) এবং প্রয়াত ওলী-আল্লাহসকলের আরওয়াহ পাক হুজুরে। ছওয়াব পাঠান হয় সমস্ত মোমেন-মোসলমানের বিদেহী রূহ মোবারকে।নবী-রাসূল (আঃ) ও ওলী-আল্লাহগণের আরওয়াহপাকে ছওয়াব রেছানী করা প্রত্যেক মোসলমানেরই কর্তব্য। কারণ তাঁহারা আল্লাহর রহমত স্বরূপ। তাঁহাদের অছিলাতেই আল্লাহপাক তদীয় সৃষ্টির প্রতি রহমত বিতরণ অব্যাহত রাখিয়াছেন। তাঁহাদের অছিলাতেই জমিতে ফসল হয়, পানিতে মাছ হয়, গাছে ফল হয়, আকাশ হইতে মিঠা পানি বর্ষে। তাঁহাদের অছিলাতেই মানুষ আল্লাহর পরিচয় জ্ঞান অর্জন করে। তাই তাঁহাদের আরওয়াহপাকে ছওয়াব নজরানা দেওয়া দুনিয়াবাসী মোসলমানবর্গের নৈতিক দায়িত্ব। অবশ্য ওলী-আল্লাহসকল বা নবী-রাসূল (আঃ) গণ আল্লাহভিন্ন অন্য কাহারো প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। কেহ তাঁহাদের রূহে ছওয়াব প্রেরণ করুক, আর নাই করুক; তাহাতে তাঁহাদের কিছু আসে যায় না। তথাপিও আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য তাঁহাদের আরওয়াহ পাকে ছওয়াব রেছানী করা। ওলী-আল্লাহ ও নবী রাসূলগণের পাক রূহে ছওয়াব নজরানা দিলে নজরানা প্রেরণকারীর জন্য রূহানী জগত হইতে তাঁহাদের পাক রূহ দু‘আ করে যাহা ছওয়াব প্রেরণকারীর জন্য কল্যাণ বহিয়া আনে।
বর্তমান জামানা অত্যান্ত মুছিবতের জামানা। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে শুধু বিপদ আর বিপদ। সর্বত্রই মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি। কোথাও শান্তি নাই। এমন ভয়াবহ জামানা বোধ করি ইতিপূর্বে আর অতিবাহিত হয় নাই। শিষ্ঠতা নাই। ভদ্রতা নাই। মানুষে মানুষে মহব্বত নাই। আগের দিনে কোন পথিক রাত্রিবেলা পথ চলার সময়ে আর একজন পথিককে দেখিলে খুশি হইত। আর বর্তমানে তাহার বিপরীত। পথিক অন্য কাহাকেও দেখিলে ভয় পায়। এই যুগে মানুষ মানুষকে হত্যা করিয়া আনন্দিত হয়। এই জামানায় ভাল থাকিতে হইলে ওলী-আল্লাহদের সার্বক্ষণিক নেক দৃষ্টি ছাড়া উপায় নাই। আর ওলী-আল্লাহগণের সার্বক্ষণিক নেক দৃষ্টি লাভ করিতে হইলে, তাঁহাদের আরোওয়াহপাকে ছওয়াব রেছানী জরুরী কর্ম। তাই উরস শরীফ বিশ্ব মানবের জন্য কল্যাণকর এক পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান। উরস শরীফ যে কেহ ইচ্ছা করিলে করিতে পারে না। আর করিলেও তাহা কবুল হয় না। ইহা কবুলিয়তের জন্য নিম্নের দুইটি শর্ত একান্তই প্রয়োজন। যথাঃ
# উরস শরীফ যেহেতু ওলী-আল্লাহগণের আরোওয়াহপাকে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়-তাই ইহা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ওলীয়ে কামেল। স্বীকৃত প্রাপ্ত ওলীয়ে কামেলের পরিচয় কি? আল্লাহপাক বলেন, ‘‘তোমরা যদি আমার সান্নিধ্য চাও, তবে জড় জগত, নূরের জগত ও সিফাতের জগত পার হইয়া আমার আকরাবিয়াতে আস।” (হাদিসে কুদসী)। কিন্তু জড় জগত ও নূরের জগত বা সিফাতের জগত পার হওয়াতো সহজ কথা নয়। দীর্ঘ সময় দুঃসাধ্য সাধনা, কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা বা অনাহার-অনিদ্রায় অতিবাহিত করিবার পরে যে সাধক নাফসের শৃংখল মুক্ত হইতে পারেন, দুনিয়ার মোহমুক্ত হইতে পারেন এবং আল্লাহভিন্ন সবকিছুকে দেল হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া এক খোদাতায়ালাকে নিজ দেলে স্থান দিতে পারেন, তিনিই পারেন জড় জগত, নূরের জগত ও সিফাতের জগত পার হইয়া খোদাতোয়ালার সান্নিধ্যে পৌঁছাইতে। যে সাধক ত্রিবিধ জগত পার হইয়া খোদাতায়ালার জাত সমুদ্রে নিমজ্জিত হন-তিনি বেলায়েতে নবুয়তের মর্যাদা পান। অতঃপর খোদাতায়ালা যদি প্রয়োজন মনে করেন, তবে তাহাকে হেদায়েতের যাবতীয় গুণাগুণ প্রদান পূর্বক দুনিয়ার দিকে ঘুরাইয়া দেন-আল্লাহভোলা মানব সমাজকে সত্য পথের দিশা দেওয়ার জন্য। ইহা কামালতে নবুয়তের মর্যাদা। যে সকল সাধক বেলায়েতে নবুয়ত ও কামালতে নবুয়তের মর্যাদাপ্রাপ্ত তাহারাই স্বীকৃতি প্রাপ্ত ওলী-আল্লাহ। কেবলমাত্র তাঁহাদের দ্বারাই যদি উরস পরিচালিত হয়, তবেই তাহা কবুলিয়তের যোগ্যতা প্রাপ্ত হয়।
# শরীয়ত ও সুন্নতের গন্ডির মধ্যে উরস উদ্যাপিত হইতে হইবে। শরীয়ত খেলাফ কর্মকান্ড উরস অনুষ্ঠানে সন্নিবেশিত হইলে তাহা আর কবুলযোগ্য থাকে না। তবে প্রথম শর্ত যথাযথ প্রতিপালিত হইলে দ্বিতীয় শর্ত এমনিতেই সম্পন্ন হয় কারণ স্বীকৃত প্রাপ্ত ওলী-আল্লাহ কখনও শরীয়তের খেলাফ কোন কাজ করেন না; করিতেও দেন না।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিল যে উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়-তাহা আমার পীর কেবলাজান হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের নির্দেশক্রমেই হয়। তিনি আমাকে বলিয়া গিয়াছেন, ‘‘বাবা, তুমি উরস কায়েম রাখিও।’’ উরসে মাইক ব্যবহার প্রসংগে আমাকে বলিয়াছেন, ‘‘যেখানে মাইক পাও, ব্যবহার কর।” পীর কেবলাজানের নির্দেশে সেই হইতে মাইক ব্যবহার শুরু হইয়াছে, আজও ব্যবহৃত হইতেছে, কেয়ামত পর্যন্ত এখানে মাইক ব্যবহার হইবে ইন্শাল্লাহ।
স্বীকৃতপ্রাপ্ত ওলী-আল্লাহগণের দরবারে বহু পূর্ব হইতে উরস উদযাপিত হইতেছে। যেমন আজমীর শরীফ, সেরহিন্দ শরীফ বা বাগদাদ শরীফে এখনও উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়।
উরস শরীফে প্রতিদিনের ফরজ ইবাদতের সাথে যে সমস্ত নফল বন্দেগী করা হয়-তাহা খুবই ফজিলতপূর্ণ। নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জেকের আজকার, আল্লাহ রাসূলের মহব্বতপূর্ণ গজল, কুরআন ও হাদীসের আলোকে ওয়াজ নসিহত, পূর্ণাংগ শরীয়তের ব্যাখ্যা, খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজনীয়ত, নবী-রাসূল (আঃ) ও ওলী-আল্লাহদের জীবন হইতে আলোচনা ইত্যাদি বন্দেগী থাকে উরস শরীফের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালায়। ইহা ছাড়াও থাকে পবিত্র ফাতেহা শরীফ ও খতম শরীফ এবং খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান হাছিলের জন্য থাকে অতিরিক্ত ইবাদত। নিশির শেষ ভাগে রহমতের ফয়েজ খেয়াল করা, ফজর নামাজান্তে কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ খেয়াল করা, জোহার নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্বে এশক মহব্বতের ফয়েজ খেয়াল করা, ফজর নামাজান্তে কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ খেয়াল করা, জোহর নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ খেয়াল করা, আছর নামাজান্তে হকিকত তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ খেয়াল করা, মাগরিবের নামাজ অন্তে পাঁচ প্রকারের ফয়েজ খেয়াল করা। যথাঃ ১। হকিকতে তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ, ২।কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ, ৩। আল্লাহপাকের খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ ৪। রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ, ৫। আনোয়ারে জেকরে এলাহিয়ার ফয়েজ এবং এশার নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর গায়রতের ফয়েজ খেয়াল করা। পবিত্র উরস অনুষ্ঠানে জাহেরী ইবাদতের সংগে থাকে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বাতেনী ইবাদত। তাই উরস শরীফ কল্যাণময় এক পবিত্র অনুষ্ঠান।
(বিষয়ঃ উরস শরীফ) ৫ম অধ্যায়
খোদাপ্রাপ্তিজ্ঞানের আলোকে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পাক দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বওলী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের প্রদত্ত নসিহত সমূহের একুশতম খন্ড “ওজিফার গুরুত্ব এবং উরসের তাৎপর্য” এর নসিহত নং-১৩০ থেকে প্রদান করা হচ্ছে-
তারিখঃ১০/০২/১৬ইং (পরবর্তী অংশ থেকে)
নসিহত -১৩০
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম
উরস শরীফ যে কেহ ইচ্ছা করিলে করিতে পারে না। আর করিলেও তাহা কবুল হয় না। ইহা কবুলিয়তের জন্য নিম্নের দুইটি শর্ত একান্তই প্রয়োজন। যথাঃ
# উরস শরীফ যেহেতু ওলী-আল্লাহগণের আরোওয়াহপাকে ছওয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়-তাই ইহা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ওলীয়ে কামেল। স্বীকৃত প্রাপ্ত ওলীয়ে কামেলের পরিচয় কি? আল্লাহপাক বলেন, ‘‘তোমরা যদি আমার সান্নিধ্য চাও, তবে জড় জগত, নূরের জগত ও সিফাতের জগত পার হইয়া আমার আকরাবিয়াতে আস।” (হাদিসে কুদসী)। কিন্তু জড় জগত ও নূরের জগত বা সিফাতের জগত পার হওয়াতো সহজ কথা নয়। দীর্ঘ সময় দুঃসাধ্য সাধনা, কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা বা অনাহার-অনিদ্রায় অতিবাহিত করিবার পরে যে সাধক নাফসের শৃংখল মুক্ত হইতে পারেন, দুনিয়ার মোহমুক্ত হইতে পারেন এবং আল্লাহভিন্ন সবকিছুকে দেল হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া এক খোদাতায়ালাকে নিজ দেলে স্থান দিতে পারেন, তিনিই পারেন জড় জগত, নূরের জগত ও সিফাতের জগত পার হইয়া খোদাতোয়ালার সান্নিধ্যে পৌঁছাইতে। যে সাধক ত্রিবিধ জগত পার হইয়া খোদাতায়ালার জাত সমুদ্রে নিমজ্জিত হন-তিনি বেলায়েতে নবুয়তের মর্যাদা পান। অতঃপর খোদাতায়ালা যদি প্রয়োজন মনে করেন, তবে তাহাকে হেদায়েতের যাবতীয় গুণাগুণ প্রদান পূর্বক দুনিয়ার দিকে ঘুরাইয়া দেন-আল্লাহভোলা মানব সমাজকে সত্য পথের দিশা দেওয়ার জন্য। ইহা কামালতে নবুয়তের মর্যাদা। যে সকল সাধক বেলায়েতে নবুয়ত ও কামালতে নবুয়তের মর্যাদাপ্রাপ্ত তাহারাই স্বীকৃতি প্রাপ্ত ওলী-আল্লাহ। কেবলমাত্র তাঁহাদের দ্বারাই যদি উরস পরিচালিত হয়, তবেই তাহা কবুলিয়তের যোগ্যতা প্রাপ্ত হয়।
# শরীয়ত ও সুন্নতের গন্ডির মধ্যে উরস উদ্যাপিত হইতে হইবে। শরীয়ত খেলাফ কর্মকান্ড উরস অনুষ্ঠানে সন্নিবেশিত হইলে তাহা আর কবুলযোগ্য থাকে না। তবে প্রথম শর্ত যথাযথ প্রতিপালিত হইলে দ্বিতীয় শর্ত এমনিতেই সম্পন্ন হয় কারণ স্বীকৃত প্রাপ্ত ওলী-আল্লাহ কখনও শরীয়তের খেলাফ কোন কাজ করেন না; করিতেও দেন না।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিল যে উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়-তাহা আমার পীর কেবলাজান হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের নির্দেশক্রমেই হয়। তিনি আমাকে বলিয়া গিয়াছেন, ‘‘বাবা, তুমি উরস কায়েম রাখিও।’’ উরসে মাইক ব্যবহার প্রসংগে আমাকে বলিয়াছেন, ‘‘যেখানে মাইক পাও, ব্যবহার কর।” পীর কেবলাজানের নির্দেশে সেই হইতে মাইক ব্যবহার শুরু হইয়াছে, আজও ব্যবহৃত হইতেছে, কেয়ামত পর্যন্ত এখানে মাইক ব্যবহার হইবে ইন্শাল্লাহ।
স্বীকৃতপ্রাপ্ত ওলী-আল্লাহগণের দরবারে বহু পূর্ব হইতে উরস উদযাপিত হইতেছে। যেমন আজমীর শরীফ, সেরহিন্দ শরীফ বা বাগদাদ শরীফে এখনও উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়।
উরস শরীফে প্রতিদিনের ফরজ ইবাদতের সাথে যে সমস্ত নফল বন্দেগী করা হয়-তাহা খুবই ফজিলতপূর্ণ। নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জেকের আজকার, আল্লাহ রাসূলের মহব্বতপূর্ণ গজল, কুরআন ও হাদীসের আলোকে ওয়াজ নসিহত, পূর্ণাংগ শরীয়তের ব্যাখ্যা, খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজনীয়ত, নবী-রাসূল (আঃ) ও ওলী-আল্লাহদের জীবন হইতে আলোচনা ইত্যাদি বন্দেগী থাকে উরস শরীফের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালায়। ইহা ছাড়াও থাকে পবিত্র ফাতেহা শরীফ ও খতম শরীফ এবং খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান হাছিলের জন্য থাকে অতিরিক্ত ইবাদত। নিশির শেষ ভাগে রহমতের ফয়েজ খেয়াল করা, ফজর নামাজান্তে কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ খেয়াল করা, জোহার নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্বে এশক মহব্বতের ফয়েজ খেয়াল করা, ফজর নামাজান্তে কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ খেয়াল করা, জোহর নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ খেয়াল করা, আছর নামাজান্তে হকিকত তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ খেয়াল করা, মাগরিবের নামাজ অন্তে পাঁচ প্রকারের ফয়েজ খেয়াল করা। যথাঃ ১। হকিকতে তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ, ২।কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ, ৩। আল্লাহপাকের খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ ৪। রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ, ৫। আনোয়ারে জেকরে এলাহিয়ার ফয়েজ এবং এশার নামাজান্তে রাসূলে পাক (সাঃ) এর গায়রতের ফয়েজ খেয়াল করা। পবিত্র উরস অনুষ্ঠানে জাহেরী ইবাদতের সংগে থাকে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বাতেনী ইবাদত। তাই উরস শরীফ কল্যাণময় এক পবিত্র অনুষ্ঠান।উরস শরীফ বৈধ্যতার প্রমাণ হিসাবে হাদীস শরীফ ও ফকীহদের মতামত প্রণিধান যোগ্য।
ফতোয়ায়ে শামীর প্রথমখন্ড ‘‘জিয়ারাতুল কবুর” শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে- হযরত ইবনে আবি শাইবা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলে পাক (সাঃ) প্রতি বছর অহুদ যুদ্ধের শহীদানদের মাজার শরীফে তশরিফ নিতেন। তাফসীরে কবির ও তাফসীরে দূরে মানছুর-এ উল্লেখ আছে- রাসূলে পাক (সাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি প্রত্যেক বছরের শুরুতে শহীদানদের কবরস্থানে তশরীফ রাখিতেন এবং ফরমাইতেরন, তোমরা দ্বীনের জন্য যে ধৈর্য (ছবর) ধারণ করিয়াছ; তাহার বিনিময়ে তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত আসুক, পরকাল তোমাদের জন্য সুখকর হউক। দয়াল নবী (সাঃ) এর পরে চার খলিফাও এইরূপ করিতেন।
হাজ্জী ইমদাদুল মোহাজেরী মক্কী (রঃ) তদীয় ‘‘ফায়াছালায়ে হাফ্তা মাসায়েল” পুস্তিকায় উরসের পক্ষে তদীয় জোরালো মতবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ফকিরের নিয়ম এই যে প্রতি বছর আমি আমার পীর মোর্শেদের পবিত্র আত্মার প্রতি ছওয়াব রেছানী করিয়া থাকি। প্রথমে কুরআন খানি করি। ইহার পর যদি সময় থাকে মীলাদ শরীফের আয়োজন করা হয় এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা এবং ইহার ছওয়াবও বখশিস করিয়া দেওয়া হয়।” তিনি আরও বলেন, ‘‘কিছু সংখক খারেজী আছে-যাহারা দিন তারিখ করা, ফাতেহা-ই দেয়াজদাহম, উরস শরীফ, কোন পীর মোর্শেদের জন্ম ও ইন্তেকাল দিবস উপলক্ষে নির্দিষ্ট দিন তারিখ ধার্য করা অথবা সভা সমিতি করা সুন্নতের খেলাফ বলিয়া গন্য করে। কিন্তু সুন্নী মতাবলম্বী ওলামায়ে কেরামের মতে উরস বা ছওয়াব রেছানীর অনুষ্ঠান বৈধ, হালাল ও জায়েয। আরবের ধার্মিক সত লোকেরা হযরত সৈয়দ আহমদ বদ্দভী (রঃ)-এর উরস অত্যন্ত ধুমধামের সহিত পালন করে। অহুদ পাহাড়ে অবস্থিত হযরত আমীর হামজা (রাঃ) এর উরস মদিনা মনোয়ারার বিশিষ্ট ছুন্নী আলেমগণ উদযাপন করিয়া থাকেন।” হযরত শাহ আব্দুল আযীয (রঃ) ছাহেব ‘‘যুবদাতুন নাসায়েহ ফি মাসায়েলিম যবায়েহ’’ গ্রন্থে উরসের বৈধতার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলেন, নেক বান্দাদের কবরসমূহ হইতে বরকত নেওয়া, ঈসালে ছওয়াব, কুরআন তেলাওয়াত, শিরনী ও খাদ্যদ্রব্য বন্টন করা দ্বারা কবর বাসীর পাক আত্মায় ছওয়াব পৌছানো ওলামায়ে কেরামের মতে ভাল।
এই সমস্ত কাজের জন্য বুজর্গানে দীনের বেছালত দিবসকে নির্ধারিত করা হয়। উদ্দেশ্য, ইহাতে তাহাদের ওফাতের কথা সকলকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া হয়। অন্যধায় এই ধরণের নেক আমল যে কোন দিন করা হোক না কোন তাহা নাজাত ও কামিয়াবীর কারণ হয়।উরস শরীফ বৈধ না হওয়ার কোন কারণ নাই। শুধুমাত্র স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন দুনিয়াদার আলেম সমাজ তাহাদের অন্ধত্বের কারণে উরসের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। উরস শরীফ নানাবিধ বৈধ ও অতীব বরকতময় অনুষ্ঠানমালায় সাজানো হয়।
উরস শরীফে কুরআন তেলাওয়াত হয়। পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম। যিনি কুরআন তেলাওয়াত করেন, প্রত্যেক অক্ষরের বিনিময়ে তিনি দশটি করিয়া নেকী পান। যে স্থানে কুরআন তেলাওয়াত করা হয়, শয়তান সেখান হইতে পলায়ন করে। সেখানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। কুরআন শরীফ তেলাওয়াতকারীর জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। কুরআন তেলাওয়াতে অন্তরের মরিচাও দূর হয়। (বায়হাকী, মেশকাত-২০৬৪)
জেকের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বহু তাগিদ দেওয়া হইয়াছে। সূরা আহযাবের ৪১ ও ৪২ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর অত্যাধিক জেকের দ্বারা এবং সকাল সন্ধায় তাছবীহ কর। সূরায়ে নেছার ১০৩ নং আয়াতে প্রকাশঃ আল্লাহপাক বলেন, ‘‘যখন তোমরা সালাত সম্পন্ন কর, তৎপর আল্লাহকে দাঁড়ানো, বসা ও শায়িতাবস্থায় স্মরণ কর।”
আবার সর্বক্ষণ জেকেরকারী বা জেকেরে কালবী হাছিলকারীকে পবিত্র কুরআনে ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ বলা হইয়াছে। সূরা আলে ইমরানের ১৯১ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘‘(তাহারাই তত্ত্বজ্ঞানী) যাহারা দন্ডায়মান, উপবিষ্ট এবং ডান বা বামে শায়িতাবস্থায় পরওয়ারদিগারকে স্মরণ করে।
রাসূলে পাক (সাঃ) এর বাণীতে প্রকাশ-জেকেরই শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। মূলতঃ যে সমস্ত ইবাদত বন্দেগী উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য নির্ধারিত হইয়াছে-তাহার সারসব্তুই হইল আল্লাহর জেকের। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত-সবেরই মূলে আছে খোদাতায়ালার স্মরণ। নামাজ ইসলামের শ্রেষ্ঠতম স্তম্ভ। অথচ যে নামাজে খোদতায়ালার স্মরণ নাই; তাহা নামাজই নয়, পন্ডশ্রম মাত্র।
জেকের দেলের ময়লা দূর হয়। দেল পরিচ্ছন্ন হয়। মুর্দা দেল তাজা হয়, জেন্দা হয়। দেলে খোদাতায়ালার নূর আসে, ফলে জেকেরকারী অনাবিল শান্তি পায়।
জেকেরকারীর জেকেরের বদলা সম্পর্কে আল্লাহপাক কুরআন শরীফে বলেন, আর্থাৎ-‘‘আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করিব।” (সূরা বাকারাহঃ ১৫২) স্রষ্টা সৃষ্টিকে (জেকেরকারীকে) স্মরণ করিবে-সৃষ্টির জন্য ইহার চেয়ে খুশীর খবর আছে কি?
পবিত্র উরস শরীফে সমবেতভাবে গজলের তালে তালে লক্ষ লক্ষ জাকেরান মহাধুমধামে আল্লাহর জেকের করে। শুধু উরস শরীফে কেন, খোদাপ্রাপ্তির প্লাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে প্রতিদিন অন্ততঃ পাঁচবার জেকেরের মাহফিল বসে। দলবদ্ধভাবে অনুষ্ঠিত জেকেরের মাহফিলকে রাসূলে পাক (সাঃ) ‘বেহেশতের বাগান’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।(মেশকাত ২১৬৪)
সমেবতভাবে জেকেরকারীদিগকে আল্লাহর একদল ফেরেশতা আপন আপন ডানা দ্বারা নিকটতম আসমান পর্যন্ত ঘিরিয়া থাকেন। উক্ত সব ফেরেশতাদেরকে সাক্ষী রাখিয়াই আল্লাহতায়ালা জেকেরকারীদেরকে ক্ষমা করিয়া দেন। শুধু তাই নয়, যে সকল লোক উল্লিখিত জেকেরের মজলিসের আশে পাশে থাকে, অথচ জেকেরকারীদের দলভুক্ত নয়, আল্লাহপাক তাহাদেরকেও ক্ষমা করিয়া দেন। (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত ২১৬০)
অথচ একদল লোক এই জেকেরের বিরোধিতা করে। এই জেকেরের মজলিস অনুষ্ঠিত হয় যে পবিত্র উরসে, সেই উরসের বিরোধিতা করে। আসলে তাহারা স্থুলদৃষ্টিসম্পন্ন দুনিয়াপূজারী আলেমভিন্ন আর কি। তাহাদের উদ্দেশ্যেই আল্লাহপাক বলেন, ‘‘সর্বনাশ সেই সব লোকের জন্য যাহাদের কালব আল্লাহর জেকের হইতে কঠিন হইয়া গিয়াছে। তাহারা স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে পড়িয়া আছে।” (সূরা জুমার ২২ নং আয়াত) ।পবিত্র উরসে আরও এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য বন্দেগী হইল মিলাদ মাহফিল। সকলেই সমেবতভাবে রাসূলে পাক (সাঃ) এর শানে দরুদ ও ছালাম প্রেরণ করে এবং তাহার জীবনের কিছু কিছু অংশ লইয়া আলোচনা করা হয়। মিলাদ মাহফিল মূলতঃ দয়াল নবী (সাঃ) এর জীবনী আলোচনা এবং তাহার প্রতি দরুদ ও ছালাম প্রেরণের মজলিস।
আল্লাহপাক তাহার বন্ধু হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) প্রতি দুরুদ ও ছালাম পাঠান, ফেরেশতাসকলও দয়াল নবী (সাঃ) এর প্রতি দরুদ ও ছালাম পাঠায়। আল্লাহতায়লারই নির্দেশ মোতাবেক আশেকে রাসূল সকল দয়াল নবী (সাঃ) এর শানে দরুদ ও ছালাম প্রেরণ করে। ইহা পূন্যময় এক পবিত্র অনুষ্ঠান। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা এবং তাহার ফেরেশতাগণ নবী করীম (সাঃ) উপর দরুদ পড়িতেছেন। অতএব হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁহার প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ কর ও সালাম প্রেরণ কর।”
রাসূলে পাক (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ শরীফ পাঠ করেন, আল্লাহপাক তাহাকে ৩০টি রহমত দান করেন আর্থাৎ তাহার আমলনামায় দশটি নেকী লেখা হয়, তাহার দশটি গোনাহ মাফ করা হয় এবং মর্যাদা দশগুণ বাড়াইয়া দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর অধিক সংখ্যায় দরুদ পাঠ করিবে, কিয়মতের দিন সেই ব্যক্তি আমার অধিক নিকটবর্তী হইবে। দরুদ ও ছালাম প্রেরণের ফজিলতের বহু কথা রাসূলে পাক (সাঃ) এর পবিত্র রাণীতে বিধৃত আছে। মিলাদ মাহফিলে সমবেতভাবে আশেকে রাসূল সকল দয়াল নবী (সাঃ)-এর প্রতি দরুদ ও ছালাম পাঠায়। তাহা ছাড়া নবীজীর জীবনীর কিছু কিছু অংশ বিশেষ করিয়া জন্ম কালীন ঘটনা সমূহ আলোচনা করা হয়। ইহাতে রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহব্বত দেলে পয়দা হয়। আর রাসূলে করীম (সাঃ) এর মহব্বতেইতো প্রকৃত ঈমান। যাহার দেলে দয়াল নবী (সাঃ) এর মহব্বত যতটুকু, তাহার ঈমানও ততটুকু। যাহার দেলে দয়াল নবী (সাঃ)-এর মহব্বত নাই; তাহার ঈমানও নাই। হাদীস শরীফে দেখা যায়, দয়াল নবী (সাঃ) বলেন, সেই ব্যক্তি মোমেন হইতে পারে না, সেই পর্যন্ত আমি তাহার নিকট তাহার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সকল লোক অপেক্ষা প্রিয় না হই। নেছায়ী শরীফে উল্লেখ আছে, যে পর্যন্ত তাহার ধন সম্পদ ও পরিবারবর্গ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই।
কাজেই বুঝা যায়, ঈমানের মানদন্ডই হইল রাসূলে পাক (সাঃ) এর প্রতি মহব্বত। আর মিলাদ শরীফের মাধ্যমে বা বারবার দয়াল নবী (সাঃ) এর প্রতি ছালাম ও দরুদ প্রেরণ ও তাঁহার জীবনী আলোচনার মাধ্যমে ঈমানদারদের দেলে দয়াল নবীর (সাঃ) মহব্বত বৃদ্ধি পায়। অথচ কিছু কিছু আলেম এই পবিত্র ও বরকতময় মাহফিল ‘মিলাদ শরীফ’-এর বিরোধিতা করে। আল্লাহতায়ালা তাহাদের বিবেককে পরিচ্ছন্ন করুন।
উল্লিখিত বন্দেগী ছাড়াও আরও বহু পুণ্যময় কর্মকান্ড পবিত্র উরস শরীফের অনুষ্ঠানমালায় সন্নিবেশিত থাকে। যেমন কুরআন হাদীসের আলোকে ওয়াজ নসিহত, শরীয়তের তাৎপর্য ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা, খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কীয় আলোচনা, খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান চর্চা আর্থাত জেকের রাবেতা, মোরাকাবা, শোগল ও মোহাসাবা, বিভিন্ন প্রকারের ফয়েজ খেয়াল করা ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়া উরস শরীফ অপরিমেয় নেকীপূর্ণ, ফজিলত ও বরকতময় এক পবিত্র অনুষ্ঠান। ইহার বিরোধিতা যাহারা করে, আল্লাহপাক তাহাদের বুঝিবার তৌফিক দিন।
হে জাকেরান ও আশেকানগণ! তোমরা যথারীতি পবিত্র উরস উদ্যাপন করিবে; আমার অবর্তমানেও করিবে। কখনোও ‘উরস’ কাজা করিবে না। আমার পীর কেবলাজান বলিয়াছেন, ‘‘উরস” কাজা করিলে পরবর্তী এক বছরের জন্য বহু দুর্ভোগ পোহাইতে হয়, যাবতীয় আয় উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়।” কাজেই উরস শরীফ যেন কাজা না হয়, সেই দিকে সদা লক্ষ্য রাখিবে। আল্লাহপাক তোমাদিগকে দয়া করুন। আমীন!